বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ঋণ খেলাপি একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। এই আর্টিকেলে আমরা ঋণ খেলাপি কী, এর বর্তমান অবস্থা, কারণ, প্রভাব, শাস্তি এবং সমাধানের উপায় নিয়ে আলোচনা করবো।
ঋণ খেলাপি কী?
ঋণ খেলাপি হলো এমন একটি পরিস্থিতি যেখানে কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা ব্যাংক বা অন্য কোন ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে নেওয়া ঋণ বা ঋণের কিস্তি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়। ঋণ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঋণের পুরো অর্থ বা কিস্তি পরিশোধ না করলেই তাকে ঋণ খেলাপি বলা হয়। ৩ মাসের বেশি ঋণ অনাদায়ী থাকলে তাকে ‘সাব স্ট্যান্ডার্ড’, ৬ মাসের বেশি থাকলে ‘ডাউটফুল’ এবং ৯ মাস থেকে ১ বছরের বেশি সময় অনাদায়ী থাকলে তাকে ‘বেড ডেট’ বলা হয়।
বাংলাদেশে ঋণ খেলাপির বর্তমান অবস্থা:
২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লক্ষ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা, যা মোট ব্যাংক ঋণের ৮.৮০ শতাংশ। ২০২২ সালে এ পরিমাণ ছিল ১ লক্ষ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন এনজিও এবং সরকারি ব্যাংকও খেলাপি ঋণের সমস্যার সম্মুখীন। ২০টি ব্যাংকের (৫ টি রাষ্ট্রায়ত্ত এবং ১৫ টি বেসরকারি) মধ্যে ৭৫% খেলাপি ঋণ রয়েছে। জনতা ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, এনআরবিসি ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক এবং ট্রাস্ট ব্যাংকের ঋণ খেলাপির হার উচ্চ।
ঋণ খেলাপির কারণ:
ঋণ খেলাপির পিছনে অনেক কারণ রয়েছে, যেমন:
- ঋণগ্রহীতাদের দুর্বল আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং ঋণ পরিশোধ করার অক্ষমতা
- ব্যাংকের ঋণ প্রদান নীতিমালায় ত্রুটি
- অসাধু ঋণগ্রহীতা ও ঋণ জালিয়াতি
- রাজনৈতিক প্রভাব ও অনিয়ম
- ঋণ আদায় প্রক্রিয়ার দুর্বলতা
- দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার অস্থিরতা
- ব্যাংক কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও অযোগ্যতা
- অপর্যাপ্ত জামানত এবং জামানতের যথাযথ মূল্যায়ন না করা
ঋণ খেলাপির প্রভাব:
ঋণ খেলাপির অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, যেমন:
- ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা
- বিনিয়োগে ধীরগতি
- মুদ্রাস্ফীতি
- কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাওয়া
- অবকাঠামোগত উন্নয়নে বাধা
- দেশীয় অর্থায়নের সীমাবদ্ধতা
- বিদেশি ঋণের উপর নির্ভরতা বৃদ্ধি
ঋণ খেলাপির শাস্তি ও সমাধানের উপায়:
ঋণ খেলাপির জন্য আইনি ব্যবস্থা রয়েছে, যেমন: আদালতে মামলা, জামানত নিলাম, ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা, গ্যারান্টরের উপর দায় বর্তায়। সরকার ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দিচ্ছে। এছাড়া ঋণ আদায়ের জন্য কিছু কার্যকরী কৌশল হলো:
- ঋণ প্রদানের আগে ঋণগ্রহীতাদের আর্থিক সামর্থ্যের যথাযথ যাচাই-বাছাই করা
- ঋণ আদায় প্রক্রিয়া সহজ ও দ্রুততর করা
- আর্থিক অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করা
- ব্যাংক কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি
- সুশাসন প্রতিষ্ঠা
- দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি
উপসংহার:
ঋণ খেলাপি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ সমস্যার সমাধানে ঋণগ্রহীতা, ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য ঋণ নীতিমালায় সংস্কার, ঋণ আদায় প্রক্রিয়ার উন্নয়ন এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য। এই বিষয়ে আরও তথ্য পাওয়া গেলে আমরা আপনাকে অবগত করব।