আখ: বাংলাদেশের অর্থকরী ফসল
আখ বা ইক্ষু (Saccharum officinarum) পোয়াসি পরিবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সপুষ্পক উদ্ভিদ। এর রস থেকে চিনি ও গুড় তৈরি হয় বলে এর চাষ ব্যাপক। 'ইক্ষু' শব্দ থেকেই 'আখ' শব্দের উৎপত্তি। বাঁশ ও ঘাসের সাথে আখের আত্মীয়তা আছে। বাংলাদেশে Saccharum officinarum প্রজাতির আখ চাষ হয়, যার মধ্যে নাটোর জেলা সবচেয়ে বেশি আখ উৎপাদন করে। এই জেলায় দুটি সরকারি চিনিকল রয়েছে, দেশের মোট ১৫ টি চিনিকলের মধ্যে।
আখের চাষ:
পরম্পরাগতভাবে আখের কান্ডের টুকরো মাটিতে পুঁতে চাষ করা হয়। তবে আধুনিক টিস্যু কালচার পদ্ধতিও ব্যাপক হচ্ছে। প্রতি বছর বাংলাদেশে গড়ে ০.৪৩ মিলিয়ন একর জমিতে ৭.৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন আখ উৎপাদিত হয়। ১৫টি চিনিকলে প্রায় ১.৫-১.৯৯ লক্ষ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদিত হয়, বাকিটা গুড় ও খাওয়ার জন্য ব্যবহার হয়। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন (BSFIC) এই শিল্প নিয়ন্ত্রণ করে। ২০০৭ সালে আরও ৩ টি বেসরকারি কোম্পানি চিনির উৎপাদনে যোগদান করে, যার মধ্যে মেঘনা গ্রুপের উৎপাদন ক্ষমতা বেশ উল্লেখযোগ্য। দেশের বাৎসরিক চিনির চাহিদা ১০-১২ লক্ষ মেট্রিক টন, যার মাত্র ১.৫ লক্ষ টন দেশে উৎপাদিত হয়, বাকিটা আমদানি নির্ভর।
আখের জাত ও বৈশিষ্ট্য:
বিভিন্ন প্রজাতির আখ (যেমন: Saccharum arundinaceum, Saccharum bengalense, Saccharum edule, Saccharum procerum, Saccharum ravennae, Saccharum robustum, Saccharum sinense, Saccharum spontaneum) থাকলেও S. officinarum ব্যবহার বেশি। আখ বর্ষজীবী উদ্ভিদ। কান্ড বেলনাকার, গিঁটযুক্ত, শাখাবিহীন। পাতা তরবারি আকৃতির। কান্ডের লম্বা ও ব্যাস জাতভেদে পরিবর্তনশীল। উত্তরাঞ্চলের আখ সরু ও শক্ত, দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের আখ তুলনামূলকভাবে নরম ও মোটা।
চাষাবাদ:
আখ উষ্ণ, আর্দ্র, রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়ায় ভালো জন্মে। পানি নিষ্কাশনযুক্ত এঁটেল দোঁআশ মাটি আদর্শ। ৬-৭.৫ pH মান উপযুক্ত। জলাবদ্ধতা ক্ষতিকর। দীর্ঘদিন কোয়েম্বেতর জাতের আখ চাষ হলেও বর্তমানে বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট ৩০ টিরও বেশি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে (যেমন: ঈশ্বরদী ১/৫৩, ঈশ্বরদী ১/৫৪, ঈশ্বরদী ১৬, ঈশ্বরদী ১৭, ঈশ্বরদী ১৮, ঈশ্বরদী ১৯, ঈশ্বরদী ২০, ঈশ্বরদী ২৫, ঈশ্বরদী ২৮, এলজেসি)।
ফসল সংগ্রহ ও ব্যবহার:
অক্টোবর-মার্চ মাসে আখ কাটা হয়। কাটার পরপর মাড়াই করা গুরুত্বপূর্ণ। চিনিকলগুলিতে উৎপাদিত আখের প্রায় ৬০% চিনি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়, বাকিটা গুড় তৈরি ও খাওয়ার জন্য। আখের উপজাত হিসেবে মদ, অ্যালকোহল, জ্বালানি, ছোবড়া, গবাদিপশুর খাদ্য এবং কাগজ তৈরি করা যায়।
কীটপতঙ্গ ও রোগবালাই:
আখের ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ (ডগার মাজরা পোকা, কান্ডের মাজরা পোকা, উইপোকা, পাতার শোষক পোকা, মিলিবাগ) ও রোগ (লাল পচা, ঝুল, নেতিয়ে পড়া রোগ, ক্লোরোসিস, সেট রট) নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ।
উপসংহার:
আখ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন, কীটপতঙ্গ ও রোগবালাই নিয়ন্ত্রণ এবং আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি দেশের চিনির চাহিদা পূরণে সহায়ক হতে পারে।